শিশুদের শিক্ষা শুরুই হয় বন্য প্রাণি দিয়ে । বাংলা বর্ণমালা শিখতে গিয়ে পড়ে অ-তে অজগর । ইংরেজী বর্ণমালা শিখতে গিয়ে পড়ে A for Anaconda. কাকতালীয় বা পরিকল্পিত যাই হোক দুইটি বন্যপ্রাণিই সাপ । দৈহিক আকৃতি, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন ইত্যাদিতেও রয়েছে সাদৃশ্য । ইন্টারনেট, ইউটিউব এর যুগে ভারচুয়ালি শিশুরা এনাকোন্ডা এবং অজগর দুটোই দেখে থাকে । এনাকোন্ডা আকার আকৃতিতে বড় হওয়াতে সব শিশুদের দৃষ্টি এনাকোন্ডার দিকে । চিড়িয়াখানায় এসেও এনাকোন্ডা খুঁজে । উদাহরণ দিই । আমার বন্ধু ড. জুবাইদুল কবির বাধন এর মেয়ে সুদূর রংপুর থেকে দুইবছর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরতে এসেছিল । বারে বারেই বলছিল ” আংকেল এনাকোন্ডা দেখান । ” অজগরের দিকে দৃষ্টি না থাকায় আমি কিঞ্চিত ব্যথিত । কারণ অজগর একটি বাংলাদেশী বন্য প্রাণি । অপর দিকে এনাকোন্ডা একটি আমাজন স্পিসিস । অর্থ্যাৎ দক্ষিণ আমেরিকার Bolivia, Brazil, Colombia, Ecuador, French Guiana , Guyana, Peru, Suriname, and Venezuela এর রেইন ফরেস্টের বাসিন্দা হচ্ছে এনাকোন্ডা ।
02.
বিশ্ব সেরা এই সর্পের অবস্থান কোথায় ?
Squamata অর্ডারের অন্তর্ভূক্ত Boidae পরিবারের সদস্য এনাকোন্ডা । বোইডি পরিবারের সকল সাপকে বোয়া (Boa) বলা হয় । সে মোতাবেক এনাকোন্ডা একটা বোয়া । আর কিকি বোয়া থাকতে পারে ? বোয়া কনস্ট্রিক্টর (Boa Constrictor) নামে এক প্রকার বোয়া আছে । অন্যান্য বোয়াদের মধ্যে Amazon Tree Boa, Brazilian Rainbow Boa, Hog Island Boa, Emerald Tree Boa উল্লেখ্য । এত বোয়ার ভীড়ে এনাকোন্ডার পরিচিতি বিশ্ব জুড়ে । ১৯৯৭ সালে আমাজন রেইন ফরেস্টে ধারণকৃত একটি এডভেঞ্চার হরর ফিল্মের নাম ছিল এনাকোন্ডা । লুইস লিওসা পরিচালিত এবং জেনিফার লুপেজ অভিনিত মার্কিন ফিল্ম ডকুন্টারির টপিক ছিল গ্রীন এনাকোন্ডা শিকার । বিশ্ব সাড়া জাগানো ফিল্মের বেশ কয়েকটি সিরিজও বের হয়েছে ।
- Livescience . com এর তথ্যমতে এনাকোন্ডা সাপের চারটি প্রজাতি বিদ্যমান । এগুলো হচ্ছে Paraguayan Anaconda, Bolivian Anaconda, Dark Spotted Anaconda এবং Green Anaconda । এই গ্রীন এনাকোন্ডাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাপ, । ওজনের দিক থেকে প্রথম এবং দৈর্ঘ্যের দিক থেকে দ্বিতীয় । দৈর্ঘ্য ২০-৩০ ফুট এবং ওজন প্রায় ২৫০ কেজি । এনাকোন্ডাদের ওয়াটার বোয়াও বলা হয় । বিশালাকৃতির কারণে ডাঙার চেয়ে জলে তারা দ্রুতগতি সম্পন্ন । আমাজন নদীতে এরা মানুষকেও প্যাঁচিয়ে ধরে ।
04.
অজগরের সাথে সাদৃশ্য :
সবাই কনস্ট্রিক্টর । অর্থ্যাৎ শিকারকে প্যাচ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে । মৃত শিকারকে আস্ত গলাধকরণ করে । এরা নির্বিষ , নিশাচর, ক্লোয়াকাল রিজিয়নে স্পার থাকে । এরা নি:সঙ্গভাবে চলাফেরা করে । শুধু প্রজননকালে একত্রিত হয় । স্ত্রী প্রাণিটি পুরুষের চেয়ে বড় হয় । ভারী দেহ ।
05.
অজগরের সাথে বৈসাদৃশ্য ।
অজগর জল, স্থল এমনকি গাছেও থাকে । স্থলভাগটা সে বেশী পছন্দ করে কিন্তু এনাকোন্ডা জলভাগটা বেশী পছন্দ করে । এনাকোন্ডা প্রিডেটরকে ফাঁকি দেয়ার জন্য জলে নেমে যায় কিন্তু পাইথন তার স্যান্ড গ্ল্যান্ড ( Located Behind Cloaca) থেকে পঁচা গন্ধ বের করে কুন্ডলি পাাঁকিয়ে বসে থাকে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ করে । যাতে প্রিডেটর মৃত মনে করে এড়িয়ে চলে । এনাকোন্ডার আয়ুষ্কাল জঙ্গলে অজগরের চেয়ে কম (১০ বছর) । স্ত্রী এনাকোন্ডা লার্ভা পাড়ে (Viviparous)। প্রায় দুই Feet দীর্ঘ লার্ভা জন্মের একঘন্টার মধ্যেই খাদ্যগ্রহণ করতে পারে যা অজগরের বাচ্চা পারে না । অজগরের বাচ্চা জন্মের পর অন্তত দুই মাস খাদ্যগ্রহণ করে না । সর্বশেষ যৌন মিলনের পর সাত মাস সময় লাগে এনাকোন্ডার বাচ্চা প্রসব করতে । অপরদিকে ডিম ফুটানোর জন্য ডিম প্যাচিয়ে বডি মাসবকুলেচার মধ্যে কৃত্রিম ঝাঁকুনি তৈরী করে ইনকিউবেশন তাপমাত্রা বজায় রাখে অজগর । এই সময়ের মধ্যে (৬০-৯০ দিন) মা অজগর যেমন খায়না তেমনি পুরো গর্ভাবস্থায় স্ত্রী এনাকোন্ডা বেবিদের নিরাপত্তার জন্য শিকার করে না । অর্থ্যাৎ সাত মাস না খেয়ে থাকে ।
06.
পাইথনের কথায় আসি । এই কমিউনিটিতে কারা আছে ? স্কোয়ামাটা অর্ডারে পাইথনিডি (Pythonidae) পরিবারের সকল সদস্যকেই পাইথন বলা হয় । এরা আফ্রো-এশিয়ান সাপ । অষ্ট্রেলিয়াতেও পাওয়া যায় । সুতরাং Old World Snake বলাই যায় । রেপটাইল ডাটাবেজ এর তথ্যমতে ৪১ প্রজাতির পাইথন আছে পাইথনিডি পরিবারে । আইটিআইএস (Integrated Taxonomic Information System) এর ট্যাক্সোনমি অনুসারে মোট ৮ টি Genus আছে পাইথন পরিবারে । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে Antaresia, Apodora, Liasis, Morelia, Leiopython ইত্যাদি । তবে Python নামক একটি স্বতন্ত্র জেনাস আছে যার অধীনে সাতটি প্রজাতি আছে । আমরা পাইথন বলতে যেন এই সাত প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকি ।
07.
আমাদের পাইথনের কথায় আসি । মানে ইন্ডিয়ান পাইথন এবং রেটিকুলেটেড পাইথন । দুই ধরনের ইন্ডিয়ান পাইথন আছে । সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে বার্মিজ পাইথন এবং তুলনামুলক ছোটটি হচ্ছে ইন্ডিয়ান রক পাইথন । Python molurus স্পিসিস এর সাব স্পিসিস হিসাবে বার্মিজ পাইথন এবং ইন্ডিয়ান রক পাইথনকে বর্ননা করা হয়েছে । তবে বর্তমানে বার্মিজ পাইথন এবং রক পাইথন আলাদা স্পিসিস হিসাবে Red List of Bangladesh এ উল্লেখ করা হয়েছে । সিলেটের বনাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবন অঞ্চলেই বিচরণ করে পাইথন । পাইথনের সাতটি প্রজাতির মধ্যে Reticulated Python অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এটি পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম সাপ তবে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে প্রথম ( (সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট ) । পৃথিবির দির্ঘতম সাপটিও বাংলাদেশে পাওয়া যায় । এতে আমরা গর্ববোধ করি ।
- বানিজ্যিক পাইথন খামারে বার্মিজ পাইথন এবং রেটিকুলেটেড পাইথন ব্যবহৃত হচ্ছে । এর পর আছে বল পাইথন (Ball Python) । বল পাইথনকে রয়েল পাইথনও বলা হয় । রয়াল পাইথন সাব সাহারান আফ্রিকাতে পাওয়া যায় । আফ্রিকান পাইথনদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাইথন হচ্ছে আফ্রিকান রক পাইথন । আফ্রিকান রক পাইথন আফ্রিকার সর্ববৃহৎ সাপ । মেজাজ চড়া । অপ্রত্যাশিত আচরণ যে কোন সময় করে বিধায় তাদের হ্যান্ডলিং একটু কঠিন । এছাড়াও আছে Angolan Python, Sumatran Blood Python, Timor Python ইত্যাদি ।
- আবদ্ধ অবস্থায় পাইথনের Metabolic Bone Disease, , Infectious Stomatitis, Submandibular Cellulitis, Necrotic Dermatitis, Respiratory Tract Infection, Ascariasis, Cryptosporidiosis, Inclusion Body Disease (IBD) ,Nidovirus infection, Septicemia, ইত্যাদি ধরণের ব্যাধি দেখা যায় । IBD সংক্রমনে স্নায়বিক লক্ষন দেখা দেয় । মুভমেন্ট কম থাকে, মুখে ঘাঁ হয়, নিউমোনিয়া থাকে, খাদ্য বমি করতে পারে ।চিকিৎসায় সুফল আসে না ।
পাইথনের রোগ নির্ণয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ড্রাগ নির্বাচন, রেজিমেন, প্রয়োগ পদ্ধতি একেবারে ম্যামালিয়ান প্রজাতির চেয়ে আলাদা । তাদের এনাটমি ও ফিজিওলজি ভিন্ন হওয়ায় পদ্ধতিসমূহও বিভিন্ন । পাইথন; রেটিকুলেটেড কীংবা বার্মিজ পাইথন যাই হোক না এরা বাংলাদেশের বন্য প্রাণি । পাইথন আমাদের গর্ব । এরা প্রকৃতিতে হান্টিং এর শিকার হলেও আবদ্ধ অবস্থায় আছে বহাল তবিয়তে । করছে বংশ বিস্তার রীতিমত ।
আমি ডাঃ শ্রাবণ হাসান সজল
একজন ভেটেরিনারিয়ান,তাই ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টরের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে দেশের শিক্ষিত সমাজকে লাইভস্টক সেক্টরে কাজ করতে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা করছি।সেই লক্ষ্যে ফেসবুক,ইউটিউব এবং ব্লগ সাইটের মাধ্যমে ফার্মারদের নানাবিধ পরামর্শ প্রদান করতে চেষ্টা করি।ইতোমধ্যে আমার ইউটিউব চ্যানেল ১ লক্ষাধিক সাবস্ক্রাইব অর্জন করায় ইউটিউব থেকে চ্যানেলটি ভেরিফাইড হয়েছে।